॥স্টাফ রিপোর্টার॥ রাজবাড়ী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক সাংস্কৃতিক বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবং জেলার উন্নয়নের অন্যতম রূপকার অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম ইন্তেকাল করেছেন(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। মৃত্যুকালে তিনি দুই পুত্র ও এক কন্যাসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
জাহানারা বেগম গত ২৪শে জুলাই ৭টার দিকে রাজধানীর বসুন্ধরার বাসভবনে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে দ্রুত এভাকেয়ায় হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্য চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এলডিপি’র একাংশের মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি সাবেক প্রতিমন্ত্রী, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ)-এর চেয়ারম্যান, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এলডিপি’র সাবেক মহাসচিব, জাতীয়তাবাদী যুব মহিলা দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, রাজবাড়ী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক সাংস্কৃতিক বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
জাহানারা বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে আহম্মেদ মুর্তাবা আমেরিকায় মেরিন এ্যাডভাইজার হিসেবে উচ্চ পদে কর্মরত। বড় ছেলে আমেরিকা থেকে দেশে আসলে শাহজাহানপুর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।
জাহানারা বেগম রাজবাড়ী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাত্র ১৭ বছর বয়সে ইডেন কলেজে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৫৯ সালে তিনি তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন। তিনি সাংস্কৃতিক বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রাথমিক শিক্ষা ও গণশিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি পঞ্চম জাতীয় সংসদে মহিলা আসন-২২ এর সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মনোনয়নে রাজবাড়ী-১ (সদর-গোয়ালন্দ উপজেলা) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
জাহানারা বেগমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি সভাপতি আবদুল করিম আব্বাসী ও মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলহাজ্ব কাজী কেরামত আলী, সাবেক সংসদ সদস্য আলী নৈওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম এবং জেলা বিএনপি গভীর শোক প্রকাশ করাসহ শোক সমাপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম বিএনপি সরকারের সাংস্কৃতিক বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় রাজবাড়ীতে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন।
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- রাজবাড়ী জেলা বার এসোসিয়েশন ভবন, রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক, সরকারী গণগ্রন্থাগার, জেলা শিল্পকলা একাডেমী, জাতীয় এ্যাক্রোবেটিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, জেলা সুইমিং পুল, আহম্মদ আলী মৃধা কলেজ, রাজবাড়ী ও পাবনা জেলার মধ্যে ফেরী যোগাযোগ ব্যবস্থা জৌকুড়া-নাজিরগঞ্জ ফেরী ঘাট চালু, কালুখালী উপজেলায় জাহানারা বেগম কলেজ, গোয়ালন্দে আহম্মদ আলী মৃধা গণগ্রন্থাগার এবং জেলায় আরো অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড তার আমলেই সম্পন্ন হয়।
অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম রাজবাড়ীর খ্যাতনামা আইনজীবী আহম্মদ আলী মৃধার পুত্র বিশিষ্ট প্রকৌশলী আহম্মদ মর্তফা চুন্নুর সহধর্মিনী ছিলেন।
জাহানারা বেগম এক সময় রাজবাড়ী জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে দলের অভ্যন্তরে গৃহ বিবাদ ছিল প্রচন্ড। বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হলে শেষ জীবনে ২০০৮ সালে বিএনপি থেকে পদত্যাগের পর তিনি (অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম) কর্ণেল অলি আহমেদের সাথে এলডিপি গঠন করেন। পরে তিনি এলডিপি থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বিএনএফ গঠন করলে তিনি তাতে কো-কনভেনর হিসেবে যোগ দেন এবং ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা সরে গেলে তিনি বিএনএফ’র চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
২০১৩ সালের ১৮ই জুন দৈনিক মাতৃকণ্ঠের সাথে বিশেষ সাক্ষাতকার হুবহু প্রকাশকরা হলো : “রাজবাড়ীতে যে উন্নয়ন করেছি আগামী ৫০ বছরেও কেউ তা করতে পারবে না” শিরোনামে ২০১৩ সালের ১৯শে জুন দৈনিক প্রকাশিত সংবাদে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ)-এর চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন, তিনি প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে রাজবাড়ী জেলায় যে উন্নয়ন করেছেন তা বিগত ৫০ বছরে কেউ করতে পারেননি এবং আগামী ৫০ বছরেও কেউ করতে পারবে না। কেউ বলতে পারবে না যে, তিনি রাজবাড়ীর কারো কাছ থেকে এতটুকু সুবিধা নিয়েছেন। শুধুমাত্র মানুষের সেবা করার জন্যই রাজনীতিতে রয়েছেন উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দল বিএনএফ ৩শ আসনেই প্রার্থী দেবে।
তিনি নিজে রাজবাড়ী-১ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। শুধু জাতীয় নির্বাচনই নয়, আগামীতে যেকোন স্থানীয় নির্বাচনেও তার দলের প্রার্থীরা অংশগ্রহণ করবে।
২০১৩ সালের ১৮ই জুন রাতে তার রাজবাড়ী শহরের সজ্জনকান্দাস্থ নিজ বাসভবনে দৈনিক মাতৃকণ্ঠের সাথে এক বিশেষ সাক্ষাতকারে তিনি এসব কথা বলেন।
অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম সাক্ষাতকারে বলেন, ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে লেখাপড়া করার সময় ১৯৫৯ সালে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নে (মতিয়া গ্রুপ) যোগ দেয়ার মাধ্যমে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে ঢাকার হাবিবুল্লা বাহার কলেজে অধ্যাপনা করার সময় ওই কলেজের কিছু সমস্যার ব্যাপারে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াউর রহমানের সাথে সাক্ষাত করলে তিনি সব সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করে দেন এবং তার দলে যোগদানের আহবান জানান। তার আহবানে সাড়া দিয়ে তিনি মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এরপর তিনি ১৯৯১ সালে গঠিত বিএনপির সরকারের সময়ে সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, ২০০১ সালের সরকারের সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারীর নির্বাচনে রাজবাড়ী-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও দীর্ঘদিন রাজবাড়ী জেলা বিএনপির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বও পালন করেছেন।
অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম আরো বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ১৯দফার আলোকেই বিএনএফ গঠন করা হয়েছে। জিয়াউর রহমানও প্রথমে বিএনএফ নামে দল গঠন করেছিলেন। তারপর জাগদল এবং সর্বশেষে বিএনপি গঠন করেন। ২০০৮ সালে বিএনপি থেকে পদত্যাগের পর তিনি (অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম) কর্ণেল অলি আহমেদের সাথে এলডিপি গঠন করেন। পরে তিনি এলডিপি থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বিএনএফ গঠন করলে তিনি তাতে কো-কনভেনর হিসেবে যোগ দেন এবং ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা সরে গেলে তিনি বিএনএফ’র চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম বলেন, রাজবাড়ী জেলা বার এসোসিয়েশন ভবন, সরকারী গণগ্রন্থাগার, রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের সম্প্রসারণ, এ্যাক্রোবেটিক সেন্টার, সুইমিং পুল, রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক, ধাওয়াপাড়া ঘাটসহ রাজবাড়ীর সিংহভাগ উন্নয়ন তিনি করেছেন। রাজবাড়ীর মানুষ যেকোন সমস্যায় যখনই তার কাছে গেছেন, তিনি তাদের কাউকে নিরাশ করেননি। যথাসম্ভব সহযোগিতা করেছেন।