শাহ্ মুজতবা রশীদ আল কামাল পৃথিবী জুড়ে এ কথা আজ সত্য বলে প্রমাণিত যে, সর্বস্তরে মাতৃভাষার ব্যবহার এবং জাতীয় উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে দেশের সর্বাধিক মানুষের গ্রহণযোগ্য ভাষাকে কাজে লগিয়েই কেবল সম্ভব দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা।
এই শাশ^ত এবং ঐতিহাসিকভাবে সত্য কথাটি সবাইকে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে এবং একুশের চেতনাকে সত্যিকারভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
পাকিস্তান আমলে আত্মবিকৃত চরিত্রের মানুষের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত বেশী। বিশেষ করে, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ঐ ধরনের মানুষের অবস্থান ছিল সব সময়েই পাকাপোক্ত। ফলে মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও তার সর্বস্তরে ব্যবহার নিশ্চিত করার দাবীতে বাঙ্গালী জাতিকে নিরন্তর সংগ্রাম করে বুকের রক্ত বিলিয়ে দিতে হয়েছে। যে ইতিহাস পৃথিবীতে আর নেই। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় বাংলার দামাল সন্তানেরা সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিকসহ আরো অনেকে সেদিন বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে রক্তের আখরে ইতিহাস রচনা করেছিল।
একুশের চেতনায় আমাদের স্বাধীকারও স্বাধীনতার আন্দোলন রচিত হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ নয় মাস মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ৭১-এর স্বাধীনতা অর্জনের পর একুশের চেতনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সর্বস্তরে কোন বাধা-বিপত্তি ছাড়াই বাংলা ভাষার ব্যবহারের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য কড়াকড়ি আরোপ করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে ২৫শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে বিশ^ দরবারে তুলে ধরেছিলেন।
একটি উপেক্ষিত বা রাষ্ট্রীয়ভাবে পদদলিত ভাষাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে যে পরিমান সময়ের প্রয়োজন বঙ্গবন্ধু সরকার সে সময় পাননি। ৭৫-এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকেই শুরু হয় বাঙ্গালীর স্বাধীনতার মৌলিক আদর্শ বিরোধী এক ভিন্ন রাজনৈতিক নীতি-আদর্শের অনুকরণ। প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সেই ধারায় বাঙ্গালীর রাজনীতি, অর্থনীতি, মুক্তিযুদ্ধ ও তার ইতিহাসই শুধু আক্রান্ত হয়নি, সুকৌশলে আক্রমন করা হয় বাঙ্গাালীর ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে। সেই থেকে শাসকগোষ্ঠী যারাই ক্ষমতায় আরোহন করেছেন তারাই ফেব্রুয়ারী মাস এলেই ভাষার জন্যে মায়াকান্না কেঁদে জনগণকে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতাত্তোর কালের প্রথম সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল একমাত্র বৈদেশিক যোগাযোগ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের সকল কর্ম-সম্পাদন হবে মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, পৃথিবীর আধুনিক প্রযুক্তি বা যে কোন উন্নয়নমূলক কাজে নিজের মতামত ও তার প্রকাশ করার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম যে কোন জাতির জন্য তার মাতৃভাষা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতিকে সবাই ধারণ ও সম্প্রসারণ করছে আজ মাতৃভাষায়। জার্মান, ফ্রান্স, জাপান, চীন, কোরিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, হাঙ্গেরী, পোলান্ড, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সবগুলো প্রজাতন্ত্রসহ পৃথিবীর এমন বহু দেশ রয়েছে যারা কেবলমাত্র আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য ইংলিশ, ফ্রেন্স, স্প্যানিশ, ল্যাটিন, জার্মান ইত্যাদি ভাষা ব্যবহার করে থাকে, বাকী সব কিছুই নিজেদের মাতৃভাষায়। আবার এমন বহু জাত্যাভিমানী জাতি রয়েছে যারা ইংরেজী বা অন্য ভাষা জানলেও বিদেশীদের সাথেও নিজের মাতৃভাষা ছাড়া কথা বলে না।
সর্বকালেই ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী তাদের নিজেদের ক্ষমতা বলবৎ রেখেছিল ঐসব দেশের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে অবদমিত করে। আমাদের এই উপমহাদেশেও যে কারণে ইংরেজীর প্রভাব রয়ে গেছে বৃটিশ সাম্রাজ্যের প্রায় দু’শ বছর শাসনের জন্য। সাম্রাজ্যবাদী পদানত এলাকা যখনই স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে তখনই তারা আঁকড়ে ধরেছে নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে। যেমন ঃ ইরান, ইরাক, ভিয়েতনাম, কাম্পোচিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মধ্য এশিয়া, আফ্রিকার অনেক দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ। বস্তুতঃ এটাই আজ ঐতিহাসিক সত্য বলে প্রমাণিত যে, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙ্গালীর স্বাধীনতা বা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার মাইলফলক।
“মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা”-অতুল প্রসাদ সেনের এই কথা প্রতিটি বাঙ্গালীরই মনের কথা। আর ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, “মাতা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি”-এই তিনে মনুষ্য জন্মের সার্থকতা। ভাষা শুধু বাঙ্গালীর মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যমই নয়-ভাষাই আমাদের শিখিয়েছে স্বাধীকার আন্দোলন করতে, স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে, অসাম্প্রদায়িক বা ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে। ভাষা শহীদদের রক্তের মর্যাদা রক্ষা ও বিশ^ জুড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন অপরিহার্য। এ জন্য প্রয়োজন শুধু ভাষার প্রতি একটু ভালোবাসা ও আন্তরিকতা। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভাষায়-“পালিলাম আজ্ঞাসুখে; পাইলাম কালে মাতৃভাষা রূপ খনি, পূর্ণ মনি জালে।” তাই, বাঙ্গালীর মায়ের ভাষা বাংলাকে সমাজ ও প্রশাসনের সর্বস্তরে প্রচলন নিশ্চিত করে ৫২-এর একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাতির সত্যিকার আত্মনির্ভরশীল উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে, সোনার বাংলা বির্নিমাণ করতে হবে।