শাহ্ মুজতবা রশীদ আল কামাল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জগতে মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১) উদার শৈল্পিক, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় শাণিত কালজয়ী ধীশক্তিসম্পন্ন বাঙালী। তাঁর সাহিত্য চর্চায় শিল্প নৈপুণ্য ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার রসবোধ দেদীপ্যমান।
ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন শোষণে একদিকে মুসলমান সমাজ হতাশায় নিমজ্জিত অন্যদিকে হিন্দু সমাজ ইউরোপীয় রেনেসাঁসের আলো আর ইংরেজ শাসকদের মদদে উজ্জীবিত। মধ্যযুগের ভাবধারা ক্রমশঃ নিষ্প্রভ হয়ে আধুনিকতার সূর্যরশ্মি দীপ্তি ছড়াতে শুরু করেছে, ঠিক এমনই যুগসন্ধিক্ষণে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যাকাশে এক নতুন নক্ষত্রের আবির্ভাব। যাঁর নাম মীর মশাররফ হোসেন। তিনি বিত্তশালী জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব কেটেছে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও রক্ষণশীলতার আবরণে আচ্ছাদিত। এমন এক সমাজে যেখানে ইংরেজী শিক্ষাকে মনে করা হতো পাপ। মূলতঃ রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম হলেও মীর মশাররফ হোসেনের পিতা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছোটবেলা থেকেই তাঁকে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী শিক্ষায় আলোকিত মানুষ হিসাবে গড়ে তোলেন। একদিকে মুন্সী জমির উদ্দিনের কাছে শিখেছিলেন আরবী-ফার্সীর প্রাথমিক পাঠ, অন্যদিকে জগমোহন নন্দীর পাঠশালা থেকে শিখেছিলেন সংস্কৃত ও ব্যাকরণ। এরপর কুষ্টিয়ায় ইংরেজী-বাংলা স্কুল, পদমদীর নবাববাড়ী স্কুল এবং কৃষ্ণনগরের কলেজিয়েট স্কুলে তিনি লেখাপড়া করেছেন। কৃষ্ণনগরের সামাজিক পরিবেশের প্রভাব তাঁর চিন্তা-চেতনায় ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে অসাম্প্রদায়িকতা ও উদার মানসিকতা। এ সম্পর্কে বিশ^জিৎ ঘোষের উক্তি প্রণিধানযোগ্য ঃ “ভিন্ন প্রকৃতির এই দুই বিদ্যা মীর মানসে কোন অসঙ্গতির বীজ বপণ করেনি, দুটিকে একাধারে গ্রহণ করে শৈশব-কৈশোরেই তিনি পেয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িকতার বীজমন্ত্র”। মীর মশাররফ হোসেন সাহিত্যচর্চার শুরুতেই কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের (১৮৩৩-১৮৯৬) গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় কাজ করার সূত্রে তাঁর সান্নিধ্য ঘটে এবং তিনি নিজেই নিজেকে কাঙাল হরিনাথের ভাবশিষ্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন। কাঙাল হরিনাথের বিভিন্ন রচনা বিশেষতঃ “বিজয়বসন্ত”(১৮৫৯) তাঁর সাহিত্য চেতনাকে শাণিত করেছে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে কারবালার কাহিনী নিয়ে তাঁর রচিত “বিষাদ-সিদ্ধু” (১৮৮৫) মর্যাদা পেয়েছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ধ্রুপদী গ্রন্থের। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে এই গ্রন্থটি শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়-ইংরেজী সাহিত্যে অনুবাদের পরে আন্তর্জাতিক বিশে^র সাহিত্য অঙ্গনেও অন্যতম জনপ্রিয় গ্রন্থ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে।
উল্লেখ্য, বিষাদ সিন্ধু গ্রন্থের বিষয় মুসলিম ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে নেওয়া হলেও ভাষা রীতি ও কাহিনী বর্ণনার গুণে এটি সকল ধর্মের মানুষের কাছে সমাদৃত হয়েছে। মীর মশাররফ হোসেন অসাম্প্রদায়িক ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি “আমাদের শিক্ষা” প্রবন্ধে লিখেছেন “বঙ্গবাসী মুসলমানদের দেশভাষা বা মাতৃভাষা বাঙ্গালা। মাতৃভাষায় যাহার আস্থা নাই, সে মানুষ নহে”। মীর মশাররফ হোসেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন সন্তানদের “বাংলা” নামকরণের মাধ্যমে। তিনি তার সন্তানদের নাম রেখেছিলেন শরৎ, শিশির, সতী, সাবিত্রী, সত্যবান, কুকী, সুনীতি, সুমতি, রণজিৎ, সুধম্বা, ধর্মরাজ ও যুবরাজ। তৎকালীন রক্ষণশীল মুসলমান সমাজের নিন্দা ও সমালোচনা তিনি সহ্য করেছেন- সন্তানদের এ ধরনের নাম রাখার কারণে।
‘অপ্রকাশিত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন ঃ ‘আকিকা হইলো, নাম রাখিবার সময় উপস্থিত। নাম রাখা হইলো মফাজ্জল হোসেন। পারস্য ভাষায় নাম রাখা হইলো। আমি সদা-সর্বদা ডাকার জন্য বাঙ্গালা ভাষায় নাম রাখিব। দুই-একজন বলিলেন বাঙ্গালা নাম রাখিবেন রাখুন, তাই বলিয়া রাম, কৃষ্ণ, শিব, দুর্গা, কালী নাম রাখা ভাল নয়। আমি বলিলাম তাহাতে দোষ কী ? আপনারা একচক্ষে দেখিবেন। কাজেই বাঙ্গালা ভাষাটা আপনাদের চক্ষেই ধরে না। অথচ বাঙ্গালার জল, বাঙ্গালার বাতাস, বাঙ্গালার শস্য, বাঙ্গালার মাটি, বাঙ্গালার সকলই আপনারা বলিতেছেন, ভাষাটার প্রতি এত ঘৃণার কারণ কী? বাঙ্গালার মাটিতে জন্মগ্রহণ করিয়া প্রথম ডাক “মা” ডাকিতেছেন। কথা ফুটিয়ে বাঙ্গালা ভাষায় কথা কহিতেছেন, অথচ সাহসের সঙ্গে বলছেন ‘শরৎ নামেই আন্দোলন মহা-আন্দোলন, আমি তাহাতে কিছুমাত্র ভীত হইলাম না। দমিলাম না। মীর মশাররফ হোসেনের অসাম্প্রদায়িক চেতনার শ্রেষ্ঠ ফসল “গো-জীবন” প্রবন্ধ। তিনি বলেছেন ঃ গো-মাংস হালাল, খাইতে বাধা নাই। কিন্তু শাস্ত্রে এ কথা লিখা নাই যে, গো-হাড় কামরাতেই হইবে, গোমাংস গলাধ ঃ করিতেই হইবে, না করিলে নরকে পচিতে হইবে। এই উপমহাদেশে হিন্দু মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যাই বেশী। তাই একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব না করে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করা উচিত। এ জন্য প্রয়োজনে মুসলমানদের গো-মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকিতে হইবে।’
হিন্দু-মুসলমানের মিলন সাধনে লেখনী ধারণ করায় মীর মশাররফ হোসেন স্বধর্মের মানুষের কাছে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। আব্দুল হামিদ খান ইউসুফ জয়ীর সম্পাদনায় টাঙ্গাইলের ‘আহমদী’ পত্রিকায় গো-জীবনের প্রথম প্রস্তাব “গোকুল নির্ম্মূল আশংকা” ছাপা হলে সেখানকার ‘আখবারে এসলামিয়া’ পত্রিকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছাপা হয়, তাতে বলা হয়, মীর সাহেব মুসলমান নন এবং তাকে কাফের ফতোয়া দেওয়া হয়। ক্ষুব্ধ মশাররফ হোসেন এদেরকে আদালতে অভিযুক্ত করেন এবং শেষ পর্যন্ত একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
সামগ্রিক বিশ্লেষণে এ কথা বলা যায় যে, মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় শাণিত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য প্রেমিক। তাঁর জীবন চেতনা ও সাহিত্য সম্ভারকে ছড়িয়ে দিতে হবে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জীবনের সর্বত্র। নতুন প্রজন্ম ও অনাগতকালের পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে তাঁর অসম্প্রদায়িক চিন্তা ও উদার মানসিকতা সম্পন্ন চেতনাবোধকে।
তথ্যসূত্র ঃ (১) আবুল আহসান চৌধুরী, “সম্পাদক মীর মশাররফ হোসেন” কালি ও কলম, কলকাতা সংস্করণ, অক্টোবর, ২০১৬ (২) আহমদ শরীফ, বাঙালী ও বাংলা সাহিত্য, দ্বিতীয় খণ্ড (ঢাকা ঃ বাংলা একাডেমী, পুনর্মূদ্রণ, ২০০৮) (৩) উপন্দ্রেনাথ ভট্টাচার্য, পূর্বোক্ত (৪) বিশ্বজিৎ ঘোষ, “বিষাদ-সিন্ধু ঃ বিষয় ও শিল্পরূপ”, বাংলা কথাসাহিত্য পাঠ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা ২০০২ (৫) আবুল আহসান চৌধুরী, “বিষাদ-সিদ্ধু ঃ পাপ অথবা প্রেমের জয়-পরাজয়”, ভোরের কাগজ, ঈদ সাময়িকী, ২০১৬ (৭) মুনীর চৌধুরী, পূর্বোক্ত (৮) মীর মশাররফ হোসেন, অপ্রকাশিত আত্মজীবনী, উদ্বৃত, আবুল আহসান চৌধুরী, “মীর মশাররফ হোসেন” বণিক বার্তা, বিশেষ সংখ্যা, ১১ আগস্ট, ২০১৬ (৯) মীর মশাররফ হোসেন, “আমাদের শিক্ষা” পাক্ষিক হিতকরী, ১৫ পৌষ, ১২৯৭ (১০) মীর মশাররফ হোসেন, “গো-জীবন”, টাঙ্গাইল, ১২৯৫ (১১) আনিসুজ্জামান “পূর্বোক্ত” (১২) ড. এম আবদুল আলীম, মীর মশাররফ হোসেন, সমন্বয়ধর্মী জীবনবোধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা। (লেখক পরিচিতি ঃ সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডাঃ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, রাজবাড়ী)।