॥স্টাফ রিপোর্টার॥ গত ২২শে ডিসেম্বর ৭১বছরে পদার্পণ করেছেন রাজবাড়ীর বরেণ্য চিত্রশিল্পী মোহাম্মদ গোলাম আলী।
চিত্রশিল্পীর পাশাপাশি তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, খ্যাতিমান ভাস্কর, ফটোগ্রাফার, ফটোসাংবাদিক, লেখক, ডিজাইনার, চিত্রাঙ্কন প্রশিক্ষক এবং স্থাপত্যকলায় বিশেষ পারদর্শী বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। ২০১৪ সালে তাকে রাজবাড়ী জেলা শিল্পকলা একাডেমীর পক্ষ থেকে চারুকলায় বিশেষ অবদানের জন্য সম্মাননা প্রদান করা হয়।
রাজবাড়ীর আপামর মানুষের কাছে আর্টিস্ট ও ফটো সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত গোলাম আলীর জন্ম ১৯৫০ সালের ২২শে ডিসেম্বর রাজবাড়ী শহরের বেড়াডাঙ্গা ৩নং সড়কের বাড়ীতে। তার পিতা মরহুম আহম্মদ আলী শেখ ছিলেন ভারতের ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের এবং পরবর্তীতে ইপিআর রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা। মা ছাইমন খাতুন ছিলেন গৃহিনী। রাজবাড়ী সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে (তৎতালীন গোয়ালন্দ মডেল হাই স্কুল) ৫ম শ্রেণীতে পড়ার সময় তার আঁকাআঁকির শুরু। বিদ্যালয়ের ড্রয়িং টিচার লুৎফর রহমানের তার চিত্রাঙ্কনের হাতে খড়ি। এরপর রাজবাড়ী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় ১৯৬৮ সালে কলেজ বার্ষিকীতে তার নিজ হাতে অংকন করা একটি প্রচ্ছদ ও একটি কবিতা(ক্ষণিকা) প্রকাশিত হওয়ার পর তার পরিচিতি বাড়তে থাকে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ছবি আঁকা তার নেশায় পরিণত হয়। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পল্লীকবি জসিম উদ্দীন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের পোর্টেট, বিভিন্ন ম্যাগাজিন, বইয়ের প্রচ্ছদ, কাঠের তৈরী অক্ষর ও প্রচ্ছদ(কাঠ খোদাই করে), মনোগ্রাম, প্যাডের লেটার হেড এবং মাটি, কাঠ ও সিমেন্ট দিয়ে ভাস্কর্য তৈরীর কাজগুলো দক্ষতার সাথে করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। রাজবাড়ী অঞ্চলে শিল্পকর্ম, সাহিত্য-রচনা, পত্রিকা প্রকাশ এবং সুভাষ সিংহের সম্পাদনায় ‘সাপ্তাহিক পাগলা মিছিল’-এ সাহিত্য সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে তার পরিচিতি আরো বেড়ে যায়। তৎকালীন এমপি মরহুম কাজী হেদায়েত হোসেনের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজবাড়ী শহরের প্রধান সড়কের পাশে ‘আলপনা আর্ট গ্যালারী’ নামে একটি বাণিজিক শিল্পালয় গড়ে তোলেন এবং এর পাশাপাশি মাটিপাড়া কাজী ছমির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। উক্ত শিল্পালয়ে সাইনবোর্ড, ব্যানার-ফেস্টুন ও কুটির শিল্পের নানা ধরনের সামগ্রী (ধান, বাঁশ-কাঠ ও মাটি দিয়ে) তৈরী করতে থাকেন।
এছাড়া নতুন নতুন লেটার স্টাইল (বাংলা-ইংলিশ-আরবী) দিয়ে সাইনবোর্ড, ব্যানার-ফেস্টুন তৈরীর এক অত্যাধুনিক শিল্পালয় গড়ে তোলেন। বর্তমানে তার ‘আলপনা আর্ট গ্যালারী’ চিত্রশালাটি রাজবাড়ী শহরের বেড়াডাঙ্গা ৩নং সড়কের নিজ বাড়ীতে অবস্থিত। সেখানে প্রতিষ্ঠানটির দু’টি শাখা বিদ্যমান। একটি শাখায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শিল্পকর্ম করেন, অন্যটিতে শিশু-কিশোরদের চিত্রাংকন(চারুকলা) প্রশিক্ষণ দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে অদ্যাবধি এটি চালু আছে। তিনি ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের খ্যাতনামা বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘ওয়ান্ডার সাইন পাবলিসিটি’তে চীফ ডিজাইনার ছিলেন। বর্তমানে তিনি জেলা শিল্পকলা একাডেমীর চারুকলা বিভাগের প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
তার অংকিত নক্সার মধ্যে রয়েছে ঃ রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ (২০ ভরি স্বর্ণ দিয়ে তৈরী), কাজী হেদায়েত হোসেন শিল্ড (ব্রোঞ্জ ও পিতল মিশ্রিত), রাজবাড়ী পৌরসভা এবং ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও নগরকান্দা পৌরসভার মনোগ্রাম(লোগো), কুষ্টিয়ার বিআরবি ক্যাবলস, পাংশা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, এনজিও কেকেএস, এসবিএমইউএস, রাজবাড়ী বাজার ব্যবসায়ী সমিতি, শ্রীপুর লজ্জাতুন নেছা কামিল মাদ্রাসার মাস্টার প্লান ও লোগোসহ বহু প্রতিষ্ঠান তার হাতের ছোঁয়ায় আজ দীপ্তমান। শিল্পী গোলাম আলীর প্রতিভার আরও কিছু স্বাক্ষর চোখে পড়ে ছবি আঁকা, লেখালেখি ও ফটোগ্রাফী ছাড়াও স্থাপত্যকলায় রাজবাড়ীর বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খুশি রেলওয়ে মাঠে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ, আলাদীপুরের জামাই পাগল মুর্শিদের মাজার গেট, রাজবাড়ী সদর উপজেলা পরিষদের প্রধান গেট, ডাঃ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ গেট, পুলিশ লাইন্সের গেট, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রবেশ পথে প্রধান সড়কে রোটারী ক্লাবের ট্রাফিক আইল্যান্ড নির্মাণে, গোয়ালন্দ মোড়ের মুক্তিযুদ্ধের ‘বিজয়-৭১ ভাস্কর্য’ ও খানখানাপুর তমিজদ্দিন খান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের গেটের নির্মাণ শৈলী।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশমাতৃকার টানে মোহাম্মদ গোলাম আলী ঘরে নবপরিণীতা স্ত্রী ও বৃদ্ধ বাবা-মাকে রেখে মুক্তি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ব্যক্তিগত জীবনে গোলাম আলী এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। ছেলে মেহেদী গোলাম আজাদ (প্রতীক আলী) একজন আর্কিটেক্ট। বর্তমানে তিনি ঢাকার গুলশানের এসেট ডেভেলপমেন্ট এন্ড হোল্ডিংস লিমিটেড নামে একটি ফার্মে সিনিয়র আর্কিটেক্ট হিসেবে কর্মরত। মেয়ে মেহেদী নূর আক্তার (প্রীতি আলী) একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী। দেশে এবং বিদেশে অনুষ্ঠিত তার অনেকগুলো একক ও দলগত চিত্র প্রদর্শনী ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
মোহাম্মদ গোলাম আলী ছবি আঁকার হাতেখড়ি দিয়েছেন অসংখ্য শিশু-কিশোরদের, এখনও দিয়ে যাচ্ছেন। তার শিষ্যদের মধ্যে খ্যাতিমান কার্টুনিস্ট (বর্তমানে দৈনিক সংবাদে কর্মরত) এম.এ কুদ্দুসসহ অনেকেই আজ নামকরা ও প্রতিষ্ঠিত চিত্রশিল্পী, ডিজাইনার, আর্কিটেক্ট, ফ্যাশন ডিজাইনার হয়েছেন। জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো তিনি শিল্পচর্চা ও শিল্প সাধনার মাধ্যমেই বেঁচে থাতে চান। ৭১তম জন্মদিনে তার ভক্ত ও শুভানুধায়ীরা শুভেচ্ছা জানানোসহ তার দীর্ঘায়ু কামনা করে দোয়া চেয়েছেন।