ডাঃ মোহাম্মদ হাসান জাফরী আশঙ্কাজনকভাবে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রতিদিনই আসছে। ডেঙ্গু নিয়ে সকলে উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে, রাজধানীবাসীর মধ্যে ডেঙ্গু আতঙ্ক বিরাজ করছে ব্যাপকভাবে। নিজেদের সতর্ক রাখার পাশাপাশি সকলের সচেতনতাই পারে কেবল নাগরিক জীবনে স্বস্তি দিতে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকা শহরে প্রতি ঘন্টায় ২.৩ জন ব্যক্তি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। চলতি মাসে এ রোগের প্রকোপ আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা কি না নাগরিক জীবনকে অস্থিরতায় ফেলতে পারে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। সকলের সর্বোচ্চ সতর্কতার মধ্যেই কেবল এই ক্রান্তিকালীন দুরবস্থা নিরাময় করা সম্ভব।
গত মাসে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, সরকারী-বেসরকারী ৪৭টি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চলতি বছর ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত মোট ২হাজার ৩শ’র অধিক রোগীর মধ্যে শুধু জুন মাসেই আক্রান্ত হন ১হাজার ৭১৩জন- যা বিগত ৩বছরে জুন মাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার তুলনায় ৫ গুণেরও বেশী। এছাড়াও জানুয়ারীতে ৩৬ জন, ফেব্রুয়ারীতে ১১৮ জন, মার্চে ১২ জন, এপ্রিলে ৪৪ জন, মে মাসে ১৩৯ জন এবং চলতি জুলাই মাসের প্রথম ৪ দিনে ৩১৮ জন আক্রান্ত হয় ডেঙ্গুজ্বরে। আক্রান্তদের মধ্যে এপ্রিল মাসে দু’জন মৃত্যুবরণ করেন।
ফ্ল্যাভিভাইরিডি পরিবার ও ফ্ল্যাভিভাইরাস দলের অন্তর্ভুক্ত মশাবাহিত এক সূত্রক আরএনএ (জঘঅ) ভাইরাসের সংক্রমণই হচ্ছে ডেঙ্গু ভাইরাস বা ডেঙ্গি ভাইরাস, যা ডেঙ্গুজ্বরের জন্য দায়ী। এডিস ইজিপ্টি মশা (অ.ধবমুঢ়ঃর) ডেঙ্গু ভাইরাসসহ ইয়েলো ফিভার ভাইরাস, জিকা ভাইরাস, চিকুনগুনিয়া ভাইরাসেরও বাহক। এই ভাইরাসের ৪টি সেরোটাইপ পাওয়া গিয়েছে। যাদের প্রত্যেকেই পূর্ণরূপে রোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম। জীবাণুবাহী এডিস মশা কাউকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হতে পারে। এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে যদি কোনো জীবাণু বিহীন এডিস মশা কামড়ায় তাহলে সেই মশা ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এই জীবাণুবাহী মশাটি যখন অপর কোন ব্যক্তিকে কামড়ায় তখন তার দেহে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে খুব সহজে একজন থেকে অপরের দেহে এ রোগের বিস্তার হতে দেখা যায়। ডেঙ্গুজ্বর প্রধানত ৩ ধরণের হয়ে থাকে-ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার, ডেঙ্গু শকসিনড্রোম।
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত অল্প দিনে সুস্থ হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিতভাবে অসুস্থতা বাড়তে থাকে এবং মৃত্যুও ঘটতে দেখা যায়। সাধারণত ভাইরাস জ্বরের যে লক্ষণ, তার সবই ডেঙ্গুজ্বরে থাকে। ডেঙ্গুজ্বর হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ হচ্ছে- সারা শরীরের মাংসপেশীতে, বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। জ্বর হওয়ার ৪ বা ৫ দিনের সময়ে এলার্জি বা ঘামাচির মতো সারা শরীর জুড়ে স্কিন র্যাশ বা লালচে দানা দেখা যায়। এ জ্বর কম বা বেশী উভয়ই হতে পারে, কোন কোন ক্ষেত্রে জ্বর ১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। খাবারে অরুচি ও বমি বমি ভাব হয়। সাধারণত জ্বর ৩/৪ দিন পর ভালো হয়ে যায়, তবে রক্তের প্লেটিলেট কমতে থাকে। কখনো মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে আবার জ্বর আসে এবং শরীরে র্যাশ দেখা দেয়। কারো কারো ক্ষেত্রে প্রচন্ড মাথা ব্যথার সাথে শরীরেও প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হয় এবং জ্বর থাকে। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তি কখনও চোখের পিছনে ব্যথা অনুভব করে। যাদের বেশী জ্বর থাকে তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে যেমন চামড়ার নীচ, নাক, মুখ, দাঁত ও মাড়ি, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাইরে, কফ, বমি ও পায়খানার সাথে রক্তক্ষরণ হতে দেখা যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট হতে পারে আবার রোগীর রক্তনালি থেকে প্লাজমা লিকেজের কারণে বুকে ও পেটে পানি জমতে পারে। পানি শূন্যতা বেশী হওয়ায় প্রস্বাবের পরিমাণ কমে যেতে পারে, অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস, কিডনী আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে। চিকুনগুনিয়া সাধারণত দ্বিতীয়বার হয় না-তবে ডেঙ্গু দ্বিতীয়বার হলে জটিলতা আরও বেড়ে যায়, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। বিশেষত ৪ ধরণের ডেঙ্গু ভাইরাসের কারণে ডেঙ্গুজ্বরও ৪ বার হতে পারে।
সাধারণত শহর এলাকায় এ জ্বরের প্রকোপ লক্ষ্য করা যায় বেশী। খুবই সাধারণ কিছু নিয়ম-কানুন, যা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সবসময় সকলের সচেতনতার জন্য প্রচারিত হয়, তা মেনে চলে আমরা এ রোগের প্রকোপ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি। দুই সিটি কর্পোরেশনের মশা নিধন অভিযান কর্মসূচী পরিচালনাসহ এ বিষয়ে আমাদের অনেক কিছুই করণীয় আছে, বিশেষভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে জনগণের সচেতনতা খুবই জরুরী। মশার প্রজনন ক্ষেত্র যাতে গড়ে উঠতে না পারে সেদিকে সকলকে নজর দিতে হবে। আতংকিত না হয়ে মশা নিধন অভিযানে নিজেদের সম্পৃক্ত করে, মশার কামড় প্রতিরোধে দিনে-রাতে ঘুমানোর সময় মশারী ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়াসহ নতুনভাবে এ রোগের জীবাণুবাহী মশার আরও প্রসার যাতে না ঘটে, সে জন্য সকলকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অভিজ্ঞতার আলোকে সচেতনতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই দেশবাসী, বিশেষ করে রাজধানীবাসী ডেঙ্গু থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে। প্রয়োজন শুধু সবার সচেতনতা আর সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগ। -পিআইডি ফিচার